-
Book Title: শ্রীহরিনামামৃত সিন্ধু
-
Language: Bengali
-
Post Date: 2025-03-29 18:54:15
-
PDF Size: 0.92 MB
-
Book Pages: 189
-
Read Online: Read PDF Book Online
-
PDF Download: Click to Download the PDF
- Tags:
শ্রীহরিনামামৃত সিন্ধু
More Book Details
Description of the Book:
<
ভূমিকা
ইহ জগতের যাবতীয় জীবগণের মধ্যে মানবগণ হইতেছে সর্বশ্রেষ্ঠ । ইহ জগতের যাবতীয় বুদ্ধিমান মানবগণের প্রায় সকলেই পরকালকে বিশ্বাস করিয়া থাকেন । ইহ কালের পর একটী পরকাল রহিয়াছে । মনুষ্যের মৃত্যুর পরবর্তীতে সেই পরলোকে তাহাকে সূক্ষ্ম শরীরে গমন করিতে হয় । মনুষ্যের মৃত্যু ইহার তাৎপর্য্য হইতেছে যে এই দৃশ্যমান নরদেহের পতন । এই দেহের পতন তো সুনিশ্চিত । এই দেহের পতন হইলেও আত্মা চিরকাল থাকিবে । এই সংসাররূপ কর্ম্মক্ষেত্রে অনিত্য জীব জড়দেহে সদ্ অসৎ কার্য্য সম্পাদিত করিয়া থাকে এবং সেই কর্ম্মানুযায়ী পরকালে ( এই দেহ পতনে বা মৃত্যুর পর ) সেই জড়দেহ সূক্ষ্মশরীরে শুভাশুভ ফল ভোগ করিয়া থাকে । মনুষ্যের মধ্যে যাঁহারা বুদ্ধিমান যাঁহারা অপ্রাকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হইয়াছেন, তাঁহারা এই বর্ত্তমান কালের ( ইহ জীবনের ) সুখ দুঃখ বা ভালমন্দে আত্মহারা না হইয়া পরকালের ভাল মন্দ বা সুখ দুঃখের চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া থাকেন। কেননা ইহকাল ক্ষণিক দিন কয়েকের জন্যই পরন্তু পরকাল অনন্ত ।
আমরা হিন্দু, আমাদিগের শিরায় শিরায় ধমনীতে ধমনীতে পরকাল বিশ্বাস স্রোত প্রবাহিত । হিন্দুর হিন্দুত্বের পরিচয় ও হিন্দুর বিশেষত্বই হইতেছে পরকাল বিশ্বাস । ফলকথা হইতেছে যে পরকাল রহিয়াছে , শাস্ত্রে বিভিন্ন প্রমাণের দ্বারা ইহা প্রতিপাদিত হইয়াছে । মৃত্যু একদিন হইবেই ইহা সুনিশ্চিত । আবার সেই মৃত্যু যে কখন হইবে তাঁহার কোন
নিশ্চয়তা নাই। কারণ শাস্ত্র বলিতেছে,—নিঃশ্বাসে নহি বিশ্বাসঃ কদা রুদ্ধো ভবিষ্যতি । অর্থাৎ নিশ্বাসের কোন বিশ্বাস নাই , প্রাণবায়ু যে কোন সময় রুদ্ধ হইতে পারে । যেকোন মুহূর্তে মৃত্যু হইতে পারে । সুতরাং ইহ জীবন ক্ষণস্থায়ী এরূপ জানিয়া ইহ জীবনের ক্ষণিক সুখদুঃখে বিভোর না থাকিয়া অনন্ত অপার পরকালের মঙ্গলের জন্য সদ্য প্রস্তুত হওয়া বুদ্ধিমান মানবগণের প্রধান কাৰ্য্য । যে ব্যক্তি যতই বুদ্ধিমান, তিনি ততই পরিণামদর্শী হইয়া থাকেন । সুতরাং বুদ্ধিমান মনুষ্য মাত্রেই পরকালের জন্য চিন্তাশীল । অতএব যাহাতে পরকালের মঙ্গল হয়, ইহজীবনে সেইকার্য্যে নিযুক্ত হওয়া প্রত্যেক মানবেরই প্রধান ও একান্ত কর্তব্য কর্ম্ম ।
পরকালের মঙ্গলের জন্য কি করা কর্তব্য, তদ্বিষয়ে বিভিন্নজন বিভিন্নমত প্রদান করিয়াছেন । পরকাল সম্বন্ধে ইহ জগতে বহু মতবাদ প্রচারিত হইয়াছে, যাঁহার সংখ্যা নির্দ্ধারণ করা সাধ্যাতীত । কোনটি ছাড়িয়া কোনটি আশ্রয় করিলে প্রকৃত পক্ষে পরকালের মঙ্গল হইবে তাহা নির্ণয় করা সুক্ষ্মধীগণের জন্যেও কষ্টসাধ্য সাধারণ মানবের ত কথাই নাই । বর্তমান কলিকালেও মতবাদের সীমাই নাই । এমন কি প্রত্যেক মানব পৃথক্ পৃথক্ মতাবলম্বী এবং তাঁহারা পরস্পর বিরোধী বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না । এই ভয়ঙ্কর মতবিরোধীময় কলিকালে জীবের ভাগ্যে গৌড়দেশরূপ উদয়াচলে শ্রীগৌরচন্দ্র উদিত হইয়া এমন একটী অপূৰ্বাদ্ভূত অদ্বিতীয় মধুর সাধন প্রচার করিলেন যে তাহাতে অতি অনায়াসে পরকালের সর্বপ্রকার মঙ্গল সাধিত হয় এবং তাহাতে কাহারও মত বিরোধ নাই । এই সাধনটী
এমন যে যাঁহার আশ্রয়ে ঐহিক সৰ্বার্থ সিদ্ধ হইয়া থাকে, যাহা সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বদেশ, কাল, পাত্রোপযোগী, মধুর এবং আনন্দজনক। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রচারিত সেই অপূৰ্বাদ্ভূত সাধনটী কি ? এই প্রশ্নের উত্তর হইতেছে যে, শ্রীভগবানের নামসংকীর্তন করাই হইল সেই মঙ্গলময় সাধন ।
শ্রীগৌরাঙ্গ জানাইলেন :—
সংকীৰ্তন হৈতে পাপ সংসার নাশন ।চিত্তশুদ্ধি সর্বভক্তি সাধন উদ্গম ।।কৃষ্ণপ্রেমোদ্গম প্রেমামৃত আস্বাদন ।কৃষ্ণপ্রাপ্তি সেবামৃতসমুদ্রে মজ্জন ।।অনেক লোকের বাঞ্ছা অনেক প্রকার ।কৃপাতে করিল অনেক নামের প্রচার ।।খাইতে শুইতে যথা তথা নাম লয় ।দেশকাল নিয়ম নাহি সর্ব সিদ্ধি হয় ।।সর্বশক্তি দিল নামে করিয়া বিভাগ । শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ।
দশে পাঁচে মিলে নিজ দুয়ারে বসিয়া ।কীৰ্ত্তন করিহ সবে হাতে তালি দিয়া ।।ইহা হৈতে সর্বসিদ্ধি হইবে সবার ।সর্বক্ষণ বল ইথে বিধি নাহি আর ।।রাত্রিদিন নাম লয় খাইতে শুইতে ।তাঁহার মহিমা বেদে নাহি পারে দিতে ।।শ্রীচৈতন্য ভাগবত । *
এই নামসংকীৰ্ত্তন সাধন যে সৰ্ববাদী সম্মত তাহাতে কিঞ্চিন্মাত্র সন্দেহ নাই । ভগবান্নামের জপ,কীর্ত্তনাদিতে কোন জাতির, কোন সম্প্রদায়ের কোন বাক্তির মত বিরোধ থাকিতেই পারে না । হিন্দুধর্ম্মের বেদ পুরাণ ইতিহাসে শ্রীভগবন্নামই হইতেছে একমাত্র জীবন স্বরূপ । শাস্ত্র বলিতেছে—
বেদে রামায়ণে চৈব পুরাণে ভারতে তথা ।আদাবন্তে চ মধ্যে চ হরিঃ সর্বত্র গীয়তে ।।
শ্রীগৌরাঙ্গের শ্রীমুখোচ্চারিত এই নামসংকীর্ত্তন মহিমা সমস্ত বেদপুরাণ ইতিহাসে সিন্ধুআৰ্য্য বিজ্ঞগণ কর্তৃক সুক্ষ্মভাবে কীৰ্ত্তিত হইয়াছে । সেই সকল প্রমাণসমূহ এই
গ্রন্থ পাঠ করিলে পাঠক অবগত হইতে পারিবেন। দুর্ভাগ্য বশতঃ কলিহত জীবগণ এই হরিনামসংকীর্ত্তন মহিমা সম্বন্ধে পূর্ব্বে অবগত ছিল না, শ্রীমন্মহাপ্রভু জগতে আসিয়া কৃপা করিয়া জীবকে ইহা জানাইয়াছেন । হিন্দুধর্ম্মের পঞ্চোপাসকের মধ্যে বৈষ্ণব, সৌর, শাক্ত, শৈব, গাণপত্য আদি উপাসকসম্প্রদায়ে শ্রীভগবন্নামসম্বন্ধে মত বিরোধ নাই । যেহেতু শৈবই হউন, শাক্তই হউন, সৌরই হউন বা গাণপত্যই হউন সকলেই বেদ শাসনাধীন । বেদানুশাসনে সর্বোপাসকের পক্ষে বিহিত সর্বোপাসনা প্রণালীর প্রথমেই আচমন মন্ত্রে শ্রীভগবন্নামােচ্চারণ করিতে হয় ও কৰ্ম্মান্তে কৰ্ম্ম নিশ্ছিদ্র করিবার জন্য সর্ব্বযজ্ঞেশ্বর শ্রীভগবানের নাম সংকীর্তন করিয়া কৰ্ম্ম সমাপন করিতে হয় ।
হিন্দু কৰ্মী, জ্ঞানী ও যোগী প্রভৃতি সর্ব প্রকার সাধক ও সিদ্ধগণের পক্ষে সাধন ও সিদ্ধ উভয়াবস্থাতেই শ্রীভগবন্নাম পরমাবলম্বন ও পরম শ্রেয় স্বরূপ, ইহা শ্রুতি স্মৃতি পুরাণে সিদ্ধ আৰ্য্যগণ কর্তৃক নির্ণীত হইয়াছে ।
শ্রীমদ্ভাগবত বলিতেছেন—
এতন্নির্বিদ্যমানানামিচ্ছতামকুতোভয়ম্ ।যোগিনাং নৃপ নির্ণীতং হরের্নামানুকীৰ্ত্তনম্ ।।
শুকদেব বলিলেন–হে রাজন ! এই যে শ্রীহরির নামানুকীৰ্ত্তন ইহা ফলাকাঙ্ক্ষী পুরুষগণের তত্তৎফলের সাধন, ইহা মুমুক্ষুগণের মোক্ষ সাধন, ইহা জ্ঞানী যোগীগণের জ্ঞানযোগের পরম ফল এবং ইহা দেশকালপাত্রোপকরণাদি শুদ্ধাশুদ্ধিগত ভয়হীন পরম সাধন, অতএব কৰ্ম্মী, জ্ঞানী, যোগী আদি সর্বপ্রকার সাধক ও সিদ্ধগণের ও সর্বজীবের ইহা অপেক্ষা অন্য পরম মঙ্গল আর নাই, ইহা কেবল আমিই ( শুকদেবই ) বলিতেছিনা, ইহা আমার পূর্বাচাৰ্য্যগণ কর্তৃক অনাদিকাল হইতে নির্ণীত হইয়াছে ।সুতরাং শ্রীভগবানের নামে কাহারও মতবিরোধ বা আপত্তি থাকিতে
পারে না । মোট কথা শ্রীনামসংকীৰ্ত্তন সৰ্ব্ববাদী সম্মত এবং এই সর্ব্ববাদী সম্মত অপূৰ্বাদ্ভূত সাধনটী যে ঐহিক, পারত্রিক, সর্ব্বার্থপ্রদ, সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, সৰ্বদেশকালপাত্রোপযোগী, মধুর ও আনন্দময় সেই বিষয় এই গ্রন্থে বহুল শাস্ত্ৰসিদ্ধান্ত সহ বিশেষরূপে আলোচিত ও প্রমাণিত হইয়াছে । পাঠকগণ অন্ত পূর্বক মনোযোগ সহকারে গ্রন্থখানি একবার আদ্যোপান্ত পাঠ করিলেই তাহা বুঝিতে পারিবেন । নামসংকীৰ্ত্তন এত অনায়াসসাধ্য যে তাহা বর্ণনাতীত, কোনও উদ্যোগ, আয়োজন, আয়াস, বা পরিশ্রমের প্রয়োজন ইহাতে নাই; খাইতে শুইতে যেকোন কার্য্যকর্ম্ম করিতে করিতে ওষ্ঠ নাড়িতে পারিলেই নামসংকীর্ত্তন সিদ্ধ হইবে । শ্রীহরিনামসংকীর্ত্তন যে কত আনন্দময় তাহা কোন ভাষায় বলিয়া ব্যক্ত করা সম্ভব নহে । পাঠক মহোদয়গণ ! একবার সুস্বরে শ্রীহরিনামসংকীর্ত্তন করিলেই নামের মধুরত্ব, আনন্দময়ত্ব অনুভব করিতে পারিবেন । গীতবাদ্য জীবমাত্রেরই আনন্দদায়ক, তাহাতে আবার স্বভাবমধুর শ্রীভগবন্নামকীর্ত্তন, সুতরাং তাহা যে মধুরাদপি মধুর তাহাতে কোন সন্দেহই নাই ।
সকল জীবের ইহকাল ও পরকালের বন্ধু ও পরম সম্বল শ্রীভগবন্নামে যে কত শক্তি এবং শ্রীভগবন্নাম যে কি বস্তু তাহা বর্ণন করিতে কেহই সমর্থ নহেন । ক্ষুদ্রজীবের পক্ষে ত দূরের কথা, সিদ্ধ আৰ্য্যগণ এমন কি ব্রহ্মা, শঙ্কর, শেষও তাহা বর্ণন করিয়া শেষ করিতে পারেন না । নাম ভগবানের গুপ্ত ভাণ্ডারের ধন । স্বয়ং ভগবান্ দয়াল গৌরই এ হেন নামকে কলিকালের মতবিরোধপূর্ণ সাধনজগতে প্রচার করিয়া সকলকেই শান্তির শীতল ছায়ায় আকৃষ্ট করিয়াছেন । কলির জীবগণ অল্পায়ু, পাপী, তাপী, বৃথাভিমানী, কুটিল,রোগাদি
উপদ্রব পূর্ণ এবং সর্বপ্রকার সাধনে অসমর্থ । দয়াল ভগবান্ গৌরচন্দ্র তাহাদের এই দূর্দ্দশা দেখিয়া কারুণ্য বশতঃ তাহাদিগকে ঐহিক পারত্রিক সর্ব্বশ্রেয়লাভের পরম সরলোপায় স্বরূপ শ্রীনামসংকীৰ্ত্তন শিক্ষা দিয়াছেন । কলিগ্রস্ত দূর্দ্দশাপন্নজীবের পক্ষে শ্রীহরিনামসংকীৰ্ত্তনই হইতেছে একমাত্র গতি, ইহা ভিন্ন কলিতে অন্যকোন গতি নাই ।
নারদীয় পুরাণে উল্লেখিত রহিয়াছে—হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্ । কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা ।।
অর্থাৎ কলিযুগে হরিনাম, হরিনাম, কেবলমাত্র হরিনামই গতি । কলিতে ধ্যান, যজ্ঞ ও পরিচর্য্যাদি অন্য গতি নাই ।
এই কলিজীবের এতই সৌভাগ্য যে কেবলমাত্র শ্রীহরিনাম সংকীর্ত্তন করিলেই জীবের সর্বস্বার্থ লাভ হইয়া থাকে, একমাত্র শ্রীহরিনাম সংকীর্ত্তনেই সৰ্ব্ব যুগগত সর্ব্ব মহাসাধনের সর্ব্ব মহাসাধ্য লাভ হইয়া থাকে ।কলিং সভাজয়ন্ত্যাৰ্য্যাঃ গুণজ্ঞা সারভাগিনঃ ।যত্র সংকীৰ্ত্তনেনৈব সৰ্বস্বার্থোঽভিলভ্যতে ।।ভাগবত ।
অর্থাৎ গুণজ্ঞ সারগ্রাহী আৰ্য্যসিদ্ধ ঋষিগণ কলিযুগের প্রশংসা করিয়া থাকেন, যেহেতু কলিতে কেবলমাত্র শ্রীহরিনামসংকীর্ত্তনের দ্বারাই সর্বস্বার্থ লাভ হইয়া থাকে ।
কৃতে যদ্ধ্যায়তো বিষ্ণুস্ত্ৰেতায়াং যজতো ! মখৈঃ ।দ্বাপরে পরিচৰ্য্যায়াং কলৌ তদ্ধরিকীৰ্ত্তনাৎ ।।
অর্থাৎ
সত্যে ধ্যানে ত্রেতায় যজ্ঞে দ্বাপরে অর্চ্চনে ।মিলে যাহা কলিতে তাহা কেশবকীৰ্ত্তনে ।।বস্তুতঃ শ্রীহরিনামসংকীর্ত্তনের শক্তি অপার । দয়াল শ্রীগৌরচন্দ্রের পার্ষদগণ জীবের প্রতি সদয় হইয়া অবিচিন্ত্য মহাশক্তি সম্পন্ন ও দুর্জ্ঞেয় স্বরূপ শ্রীভগবন্নামের শক্তি ও স্বরূপতত্ত্ব বেদ-পুরাণাদি হইতে সংগ্রহ করিয়া বিভিন্ন গ্রন্থে প্রকাশ করিয়াছেন তাঁহার ফলেই অধমাধম আমরা হরিনামের শক্তি ও স্বরূপতত্ত্ব কিয়ৎপরিমাণে জানিতে পারিয়াছি ।
গ্রন্থকার
পূর্ব্ব মহাজনগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া এই গ্রন্থে নামের স্বরূপ ও শক্তি তত্ত্ব লিপিবদ্ধ করিয়াছেন । গোস্বামীবৰ্য্য শ্রীপাদ সনাতন গোস্বামী শ্রুতিস্মৃতিপুরাণ হইতে নামের শক্তি ও স্বরূপতত্ত্ব সংগ্রহ করতঃ শ্রীহরিভক্তিবিলাসে যাহা লিখিয়াছেন তৎসমস্ত এবং তদতিরিক্ত প্রাচীন ও আধুনিক মহাজনগণ নামসম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন সে সমুদায় একত্রিত করতঃ গ্রন্থকার এই গ্রন্থে সুশৃঙ্খলভাবে ক্রমানুযায়ী সুবিন্যাস করিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছেন ।
নাম পরম মঙ্গলময়, পরম কল্যাণময় । এই কথা ভাবিবার প্রয়োজন নাই যে আমি যখন শ্রদ্ধার সহিত নামগান করিলাম তখন তো তাহা ফলদায়ী হইবে পরন্তু অশ্রদ্ধায় উচ্চারিত নামে কি ফল প্রাপ্ত হইবে ? । ইহার উত্তর হইতেছে যে, শ্রদ্ধায় হউক বা অশ্রদ্ধায় হউক নাম লইলেই জীবের পরম মঙ্গল হইয়া থাকে । শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্র বলিতেছে—সাঙ্কেত্যং পারিহাস্যং বা স্তোভং হেলনমেব বা ।বৈকুণ্ঠনামগ্রহণমশেষাঘহরং বিদুঃ ।।
অর্থাৎ সঙ্কেতে পরিহাসে স্তোভে বা হেলাতে ও ভগবন্নাম গ্রহণ করিলেও অশেষ পাপ হরণ হইয়া থাকে ।
সকৃদপি পরিগীতং শ্ৰদ্ধয়া হেলয়া বা । ভৃগুবর নরমাত্রং তারয়েৎ কৃষ্ণনাম ।। ( প্রভাসপুরাণ )অর্থাৎ হে ভৃগুবর !
শ্রদ্ধায় হউক বা হেলায় হউক কেহ যদি একবার মাত্র কৃষ্ণনাম গায়ন করিয়া থাকে তাহা হইলে হরিনাম সেই মনুষ্যকে উদ্ধার করিয়া থাকে ।
শাস্ত্র বলিতেছে যে, নিঃশ্বাসে নহি বিশ্বাসঃ কদা রুদ্ধো ভবিষ্যতি । কীর্ত্তনীয়মতো বাল্যাদ্ধরের্নামৈব কেবলম্ ।।
অর্থাৎ নিঃশ্বাসের কোন বিশ্বাস নাই , প্রাণবায়ু যে কোন সময় রুদ্ধ হইতে পারে । যেকোন মুহূর্তে মৃত্যু হইতে পারে সেহেতু বাল্যকাল হইতেই হরিনাম কীর্তন করা উচিত ।
শাস্ত্র আরও বলিতেছে—আব্রহ্মস্তম্বপর্য্যন্তং সর্ব্বং মায়াময়ং জগৎ ।সত্যং সত্যং পুনঃ সত্যং হরের্নামৈব কেবলম্ ।।অহো দুঃখং মহাদুঃখং দুঃখাদ্ দুঃখতরং যতঃ ।কাচার্থং বিস্মৃতং রত্নং হরের্নামৈব কেবলম্ ।।
ব্রহ্মা হইতে স্তম্বপর্য্যন্ত সকল জগত সংসার কেবল মায়াময় , কেবল মাত্র হরিনামই সত্য,হরিনামই সত্য, হরিনামই সত্য । অহো ! দুঃখ, মহান দুঃখ, দুঃখতর, দুঃখতম, ইহা হইতেও অধিক হইল শোক, যাঁহা কাঁচের ন্যায় । এক শোকরূপী কাঁচ হইতে নিবৃত্তির হেতু ভগবান কৃপা করিয়া বিষয়াসক্ত জীবসমূহকে হরিনামরূপী মহারত্ম প্রদান করিয়াছেন । যাঁহার কীর্ত্তন মাত্রেই সকল দুঃখের নিবৃত্তি হইয়া যায় ।
শাস্ত্রে আরও রহিয়াছে যে—হরিঃ সদা বসেত্তত্র যত্র ভাগবতা জনাঃ ।গায়ন্তি ভক্তিভাবেন হরের্নামৈব কেবলম্ ।।
ইহার অর্থ হইতেছে যে, যেস্থলে ভক্তগণ ভক্তিভাবে হরিনাম কীর্ত্তন করিয়া থাকে সেস্থলে সাক্ষাৎ ভগবান্ সর্বদা বিরাজিত থাকেন ।
শাস্ত্রে হরিনামের কত যে মহিমা বর্ণিত হইয়াছে তাহা লিখিয়া শেষ করা আমার ন্যায় অধমাধমের পক্ষে সম্ভব
নয় । হরিনাম যে সর্বশ্রেষ্ঠ তাঁহাতে কোন দ্বিমত নাই । হরিনাম স্মরণমাত্রেই জীবমাত্র সকল পাপ হইতে মুক্তিলাভ করিয়া থাকে । বিশেষত কলিযুগের প্রাণীদিগের জন্য শ্রীহরিনামই পরম সাধ্য ও পরম সাধন । যিনি ভক্তিভাবে শ্রীহরিনামের আশ্রয় করিয়া থাকেন অবশ্যই তাঁর জীবন সফল হইবে, তিনি নিশ্চই ভগবদ্ধামে গমন করিবেন । শ্রীহরিনাম জপ-কীর্ত্তনাদি করিবার জন্য বর্ণাশ্রমধর্মের কোন নিয়ম নাই । ইহ জগতের সকল জীবই হরিনাম কীর্ত্তনের অধিকারী, সকলেই হরিনাম কীর্ত্তন করিয়া সকল পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া পরমপদকে প্রাপ্ত করিতে পারেন । হরিনাম মানবমাত্রের জন্যই কল্যাণকর ।
এই গ্রন্থে গ্রন্থাকার শ্রীসীতানাথ দাস ভক্তিতীর্থ মহাশয় শ্রীহরিনামের মহিমাকে বিশেষরূপে তুলিয়া ধরিয়াছেন । এই গ্রন্থখানি বহুকাল পূর্ব্বে প্রকাশিত হইয়াছিল এবং বৈষ্ণব সমাজে অতীব সমাদৃত হইয়াছিল। বহুকাল যাবৎ ইহার প্রকাশন না হওয়ায় গ্রন্থখানি বিলুপ্ত হইয়াছে । আমি গ্রন্থখানির একটি মাত্র প্রতিলিপি সংগ্রহ করিয়া পুনরায় লিখিয়া ইহার সম্পাদনা করিয়াছি । পূর্বে যখন এই গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়াছিল তখন গ্রন্থখানিতে উদ্ধৃত শ্লোকসমূহে অনেক ত্রুটি রহিয়াছিল । শ্রীসনাতন দাস শাস্ত্রীজী মহারাজ এই গ্রন্থের ত্রুটি বিচ্যুতি সংশোধন করিয়া দিয়াছেন সেহেতু তাহাকে আমি আন্তরিকভাবে বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি । নিবেদক রঘুনাথ দাস
- Creator/s: পণ্ডিত শ্রীরঘুনাথ দাস শাস্ত্রী
- Date: 1/21/2021
- Year: 2021
- Book Topics/Themes: Harinamamritasindu, হরিনামামৃতসিন্ধু
Leave a Reply